আনন্দবাজার পত্রিকায় গত ২০ অগাস্ট আমার মত অসংখ্য পাঠকের প্রিয় লেখক ডঃ অশোক মিত্রের অবিশ্বাস ইতিহাসের উত্তরাধিকার লেখাটি খুব সময়োপযোগী । আমরা মুগ্ধ হবার আবার এক অবকাশ পাওয়া গেল । বেশ কয়েক দশক ধরে একটা অদ্ভুত ধারণা সৃষ্টির চেষ্টা হচ্ছে যে কায়দ-এ-আজম মহম্মদ আলি জিন্না এক সাম্প্রদায়িকতাবাদ-বিরোধী নেতা। কারণ তিনি নাস্তিক, শুয়োরের মাংস খেতেন, নমাজ পড়তেন না, রোজা করতেন না। কিন্তু তিনিই যে ১৯৪৬ সালে ডাইরেক্ট অ্যাকশন তথা মুসলমানদের হিন্দুদের বিরুদ্ধে দাঙ্গার আহ্বান জানিয়েছিলেন যাতে পাকিস্তান রাস্ট্র গঠনের স্বপ্ন দ্রুত রূপায়িত হতে পারে, এটা তো কঠোর সত্য। এঁরা জিন্নাকে নতুন রাজনৈতিক আইডেনটিটি দিতে চান এবং তার সমর্থনে জিন্নার পাকিস্তান গণ পরিষদে ১১ অগাস্ট, ১৯৪৭-এ প্রদত্ত বক্তৃতা থেকে উদ্ধৃতি দেন । তার অংশ-বিশেষ-এর বাংলা তর্জমা করে দিচ্ছি। “ আমি জানি অনেকেই ভারতের বিভাজন, পাঞ্জাব ও বাংলা ভাগ মেনে নিতে পারছেন না। কিন্তু এখন যখন এটা মেনে নেওয়া হয়েছে, এরই মধ্যে আমাদের কাজ করতে হবে। এটাই আমাদের প্রত্যেকের কর্তব্য । আপনাদের মনে রাখতে হবে, যে বিপ্লব সংঘটিত হল, সেটা অভূতপুর্ব । … একটা বিভাজন হতই । হিন্দুস্তান ও পাকিস্তান, উভয় দিকেই জনগণের একাংশ এটা মেনে নিতে পারেনি, যারা এটা চায়নি। আমার বিচারে এ ছাড়া কোন সমাধানের পথ ছিল না। একটি ঐক্যবদ্ধ ভারতের ধারণা কার্যকরী হত না। ... এখন আমাদের যদি এই মহান রাস্ট্র পাকিস্তানকে সুখী করতে হয়, আমাদের সামগ্রিক ভাবে কাজ করতে হবে,জনগণের, বিশেষত দরিদ্র জনতার কল্যাণের জন্য নিবেদিত প্রাণ হতে হবে। আপনারা হাত মিলিয়ে কাজ করলে, অতীতের কথা মনে না রাখলে, আপনারা সফলকাম হবেনই, এবং জাতি, ধর্ম ও বর্ণ নির্বিশেষে আমাদের সবাইকে এক সাথে কাজ করতে হবে। মুসলমান অর্থাৎ পাঠান, পাঞ্জাবী, শিয়া, সুন্নি ইত্যাদি ও হিন্দু তথা ব্রাহ্মণ, বৈষ্ণব, ক্ষত্রিয়, বাঙালি, মাদ্রাজী প্রভৃতি মিলে। ... আপনারা এখন মুক্ত মনে ইচ্ছেমত মন্দিরে যান, মসজিদে যান, বা পাকিস্তানের যে কোন ধর্ম স্থানে যাবেন। যে কোন ধর্ম, বর্ণ আপনার হতে পারে, রাস্ট্রের সেখানে কোন ভূমিকা নেই”। (বলা বাহুল্য, এটা আক্ষরিক অনুবাদ নয় ।)
ডঃ মিত্র জিন্নার প্রথম পূর্ব পাকিস্তান সফরে এসে যা বলেছিলেন, তা স্মরিয়ে দিয়ে জিন্না নিয়ে এক গুরুত্বপূর্ণ বিতর্ক উস্কে দিয়েছেন। পাকিস্তানের জন্মের অব্যবহিত পরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্জন হল সভাকক্ষে ছাত্রছাত্রী ও অধ্যাপকদের কাছে (চোস্ত ইংরেজিতে) যা বলেছিলেন, ও তার প্রতিক্রিয়া কি হয়েছিল, তা ডঃ মিত্র প্রাঞ্জল ভাষায় তুলে ধরেছেন । “ পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হবে উর্দু এবং একমাত্র উর্দু। সঙ্গে সঙ্গে সভাকক্ষের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে ছাত্রদের আর্ত প্রতিবাদী চিৎকার: ‘কায়েদ-এ-আজম জিন্দাবাদ, রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই!’ জিন্না থমকালেন, ক্রুদ্ধ নয়নে চার দিকে তাকালেন, তাঁর মুখাবয়ব রোষায়িত, একটি কথাও না বলে ওখানেই বক্তৃতা থামিয়ে কার্জন হল থেকে নিষ্ক্রান্ত হলেন। ছাত্র সম্প্রদায় কিন্তু অদম্য আবেগে চেঁচিয়ে চলেছে, ‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই, কায়েদ-এ-আজম জিন্দাবাদ’। কায়েদ-এ-আজম তথা পাকিস্তান রাষ্ট্রের প্রতি তাদের আনুগত্যে কোনও দ্বিধা নেই, কিন্তু নবগঠিত রাষ্ট্রের অন্যতম ভাষা হিসেবে তাদের মাতৃভাষা বাংলাকে সরকারি স্বীকৃতি দিতে হবে। উর্দু ভাষা সম্পর্কে তাদের কোনও বিরাগ নেই, কিন্তু বাংলা’কেও রাষ্ট্রভাষা হিসেবে গণ্য করে সমান মর্যাদা দেওয়া প্রয়োজন এটা তাদের আবেদন, অনুরোধ, দাবি”। সেই সময় তাঁর সফর সঙ্গী ছিলেন ঞ্জিন্নার সহোদরা ফতিমা জিন্না।
আমার অগ্রজ বন্ধু সি পি আই (এম-এল) লিবারেশ্যনের কলকাতা জেলা সদস্য অমলেন্দু ভূষণ চৌধুরী তখন কিশোর, ময়মনসিং-এ স্কুল-এ পড়েন। তিনি প্রায়ই স্মৃতিচয়ন করেন । বলেন -“ সারা পূর্ব পাকিস্তান জিন্না ও তাঁর বোন বেগম ফতিমা জিন্না রেল পথে সুর্মা মেল-এ ঘুরেছিলেন। প্রধান প্রধান স্টেশনে ইংরাজীতে ছোট্ট বক্তৃতায় বলতেন – ‘উর্দু আমাদের রাস্ট্র ভাষা ও আমাদের প্রধান ধর্ম ইসলাম’ । ফতিমা জিন্না সেটা উর্দুতে অনুবাদ করতেন। জিন্না উর্দু বলতে পারতেন না”। বুঝুন ঠেলা, যিনি রাস্ট্রপ্রধান হিশেবে বলছেন, ‘উর্দু আমাদের রাস্ট্র ভাষা’, তিনি নিজেই উর্দু বলতে পারতেন না। আবার বলতেন ‘আমাদের রাস্ট্রধর্ম ইসলাম’ । যিনি কিছুদিন আগে পাক গণ পরিষদে বলেছিলেন – মুক্ত মনে ইচ্ছেমত মন্দিরে যান, মসজিদে যান, বা পাকিস্তানের যে কোন ধর্ম স্থানে যাবেন। যে কোনো ধর্ম, বর্ণ আপনার হতে পারে, রাস্ট্রের সেখানে কোনো ভূমিকা নেই’, তিনি ঢাকায় ছাত্রদের ও পূর্ব পাকিস্তানের আম জনতাকে ঠিক উল্টোটাই বললেন । এটা স্রেফ হিপক্রেসি। আর কিছু নয়। তাঁকে নিয়ে মাতামাতি, তাঁকে মৌলবাদী মোল্লাদের থেকে মানসিকতার দিক থেকে আলাদাভাবে দেখা হবে কেন বুদ্ধিজীবি- অধ্যাপক মহলে ?
কিন্তু ডঃ মিত্র এই লেখাতেই হিন্দীভাষীদের প্রতি অহেতুক ঘৃণা মঞ্জুর করেছেন। “আমরা লড়াই করে পাকিস্তানের শৃঙ্খল থেকে নিজেদের মুক্ত করেছি, স্বাধীন বাংলাদেশ গঠন করেছি, আর আপনারা ওই খোট্টাদের চিরকালের গোলাম বনে গেছেন”। -বাংলাদেশীয় কারো কথা হয়তো উনি উদ্ধৃত করছেন। কিন্তু ওনার সেই বক্তাকে খেয়াল করিয়ে দেওয়া উচিত ছিল যে ওনার ‘খোট্টা’ বলা উচিত হয়নি। ডঃ মিত্র সেটা করেন নি বোঝাই যাচ্ছে। বাংলাদেশ যুদ্ধে দুই ফ্রন্টে (পূর্ব ও পশ্চিম আকিস্তানে) ৩০০০ বেশী ভারতীয় জওয়ান প্রাণ দিয়েছিলেন। এদের মধ্যে নিশ্চয়ই বহু শত জওয়ান ছিলেন যাঁরা হিন্দীভাষী তথা ডঃ মিত্রর উল্লিখিত ওই বক্তার ভাষায় ‘খোট্টা’!
এই খানটায় আমার আপত্তি এবং ক্ষোভ। যিনি তিন দশক আগে বাম ফ্রন্ট সরকারের অর্থমন্ত্রী থাকা কালে পশ্চিমবঙ্গ বিধান সভার চত্বরে বলেছিলেন, ‘আমি ভদ্রলোক নই, আমি কমিউনিস্ট’, তাঁর লেখনীতে এই উগ্র প্রাদেশিকতার অনুমোদন মেনে নেওয়া যায় না। এতো হিন্দীভাষীদের ছোটলোক বলার শামিল! এই ব্যক্তিই আবার বলেন ‘আমি ভদ্রলোক নই , আমি কমিউনিস্ট’।
ফ্রন্টিয়ারের পাঠকদের কাছে পেশ করছি ১৯৮০ দশকে অধুনালুপ্ত প্রতিক্ষণ মাসিক পত্রিকায় ‘আমি ভদ্রলোক নই’ বলা নিয়ে সমালোচনা করেছিলাম। তাঁকে ‘আগুনখেকো’ বলে অভিহিত করেছিলাম। একাধিকবার ইংরিজীতেও লিখেছি (অবশ্য আমার দুর্বল ইংরিজীতে। অশোকবাবুর মত ইংরিজী লেখা আমার দুঃস্বপ্নেরও বাইরে।) আসলে তিনি আচরণে পুরোদস্তুর আর বিশ্বাসে মার্ক্স-বিচ্যুত, এটা আমার সুস্পস্ট অভিমত। আমি অবশ্য ভদ্রলোক আর কমিউনিস্ট কথা দুটির মধ্যে বৈরিতার অর্থ খুঁজে পাইনি ।
তাঁর আত্নজীবনী ‘আপিলা-চাপিলা’তে যে সিপিআই(এম) নেতাদের উচ্ছ্বসিত প্রশংসা ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে – ই এম এস নাম্বুদিরিপাদ, পি সুন্দরাইয়া, জ্যোতি বসু, সরোজ মুখার্জি, মুজফফর আহমদ প্রভৃতি – তাঁরা সবাই নিপাট ভদ্রলোক । অবশ্য অজয় ঘোষ, পূরণ চাঁদ যোশী, ভবানী সেন, কংসারি হালদার ইত্যাদির উল্লেখ তাঁর আত্নকথায় নেই। কারণ তাঁরা সিপিআই-তে থেকে গিয়েছিলেন। যাঁরা গরীব-গুর্বো বা মজুরশ্রেণী থেকে এসেছিলেন বা মিম্ন বর্গীয়, তাঁদের নাম নেই। ধরুন অবিভক্ত বঙ্গে দিনাজপুর থেকে বঙ্গীয় ব্যবস্থাপক সভায় ১৯৪৬ সালে সিপিআই –এর টিকিটে নির্বাচিত দরিদ্র কৃষক সন্তান রূপনারায়ন রায়ের কথা। সেবার সারা ভারতে আট জন সিপিআই বিধায়ক জিতেছিলেন, তাঁদের সাত জনই সংরক্ষিত কেন্দ্র থেকে। তিনিই শুধু অসংরক্ষিত কেন্দ্র থেকে জিতেছিলেন। তেভাগা আন্দোলনের সম্মুখ সারির নেতার কাছে ভূতলশায়ী হয়েছিলেন দিনাজপুরের দোর্দন্ডপ্রতাপ জোতদারদের অন্যতম ও কংগ্রেস প্রার্থী ভবেশ রায়। অশোকবাবুর কোন লেখায় রূপনারায়ন রায়ের নাম নেই। নেই তেভাগার শহীদ চিয়ার সাই শেখ, শিবরাম মাঝি, সমিরুদ্দিন, যশোদারাণী সরকার, কৌশল্যা কামারনী, মাঝি সরেশ গহনুয়া মাহাতো, রবিরাম সর্দার ইত্যাদির কথা। এরা কেউ ডঃ মিত্রের ভাষায় ভদ্রলোক ছিলেন না। এরা সিপিআই ও কৃষক সভার ডাকে তেভাগা আন্দোলনে ঝাঁপ দিয়ে নিঃশেষে প্রাণ দিয়েছিলেন । এরা অশোকবাবুর মত এলিট ‘কমিউনিস্ট’ থেকে যোজন যোজন দূরে ছিলেন। সোমনাথ হোরের ‘তেভাগার ডায়েরি’তে খোদাই করা আছে ভূমিহীন আধিয়ারদের (বর্গাদের উত্তর বাংলায় আধিয়ার বলা হ’ত, বোনা ধানের আধাভাগ পেতেন বলে) নির্ভয় লড়াইয়ের মেজাজ, ‘আপিলা-চাপিলা’য় তার কণামাত্র নেই।
মার্ক্সীয় দৃষ্টিতে দেখলে তিনি কতটা মার্ক্সবাদী এ নিয়ে প্রশ্ন তুলেছিলাম ১৯৮০র দশকে ‘আমি কমিউনিস্ট’ দাবি যাচাই করতে প্রয়াসী হয়ে। তাঁর পি এইচ ডি থিসিস – Share of Wages in National Income. আমার প্রিয় গ্রন্থ। একেবারে প্রথম দিকে অর্থবিজ্ঞানে নোবেল পুরস্কার জয়ী টিনবার্জেনের গবেষণা কেন্দ্র নর্থ হল্যান্ডের স্কুল অফ ইকনমিক্স থেকে ও তাঁর কাছেই ডঃ মিত্র গবেষণা করেছিলেন ১৯৫৪ সালে। মন্ত্রী থাকাকালীন তাঁর থিসিসটি পুস্তকাকারে প্রকাশিত হয়। ভূমিকায় লিখেছিলেন, তাঁর সিদ্ধান্তগুলি প্রাসঙ্গিকতা হারায় নি । তিনি বইটির প্রথম অধ্যায়ে লিখেছেন, মার্ক্স –কথিত ‘থিয়োরি অফ রেলেটিভ ইমপভারিশমেন্ট অফ প্রোলেটারিয়েট’ খাটেনি প্রতীচ্যের দেশগুলিতে। কারণ তাঁদের মজুরি কমেনি একই স্তরে রয়ে গিয়েছিল ১৯৫০-এর দশকে।
‘আপিলা-চাপিলা’তে তিনিই লিখেছিলেন মার্ক্স ভুল করতেই পারেন না। তাঁর বক্তব্যের সমর্থনে সে সব গবেষণা পত্রের উল্লেখ করেন তার অন্যতম এ এল বাউলির Wages and Income in the United Kingdom since 1860। কিন্তু রেলেটিভ ইমপভারিশমেন্ট যাচাই করতে শুধু মজুরি হারের ট্রেন্ড-এর উপর নির্ভর করব কেন? সোভিয়েত অর্থ বিজ্ঞানী টিমোফিয়েভ দেখিয়েছিলেন যে শ্রম উৎপাদনশীলতা সূচক (index of labour productivity) ১৮৪০-৪৯ থেকে ১৯৬০-৬৪তে ৪০ থেকে বাড়লেও প্রকৃত মজুরী বেড়েছিল অনেক কম ৬৭ থেকে ১৩৫ (T Timofiev The Working Class and Social Progress, Moscow 1978)। যে হারে শ্রম উৎপাদনশীলতা সূচক বেড়েছিল, আসল মজুরি বেড়েছিল অনেক কম হারে। এটাই রেলেটিভ ইমপভারিশমেন্ট এর প্রতিফলন, কারণ বর্ধিত শ্রম উৎপাদনশীলতা-জনিত উদ্বৃত্ত মূল্যের ফয়দা লুটেছে পুঁজিলগ্নীকারীরা। সুতরাং মার্ক্সের সিদ্ধান্ত ঠিক ছিল, আছে। ডঃ মিত্র স্পষ্টত বিভ্রান্তকারী সিদ্ধান্ত পেশ করেছিলেন। ভেবে দেখেন নি যে, উদ্বৃত্ত মূল্য তত্ব নিয়েই প্রশ্ন তুলেছিলেন।