আদিবাসীরা পশ্চিমবঙ্গে এখনো অবহেলিত
শঙ্কর রায়
প্রদীপ বক্সি ২০০৫ সালে প্রথম শবর জাতীয় সম্মেলনে পেশ করা ‘আধুনিক ভারতে আদিবাসীদের সাথে ধারাবাহিক প্রতারণার ইতিহাস প্রসঙ্গে’ শিরোনামে এক প্রবন্ধে লেখেন, “আয়ুর্বেদের সুবিশাল বনৌষধি সংক্রান্ত জ্ঞানভান্ডারের অনেকটাই আদিবাসীদের কাছ থেকে পাওয়া। আমাদের আদিবাসীরা প্রায় ৯০০০ গাছ-গাছড়ার কথা জানতেন। আর তার মধ্যে ৭৫০০ লতাগুল্ম হতে জাত ওষুধ মানুষের ও গৃহপালিত পশুপাখির সুস্বাস্থ্যের স্বার্থে ও রোগ নিরাময়ের জন্য ব্যবহার করতেন। গাছের ডাল কেটে দাঁতন কাঠি ব্যবহার করার আর রান্নায় ও মলমে হলুদ ব্যবহার করার শিক্ষাও আমরা আদিবাসীদের কাছ থেকে পেয়েছি”। গ্রামের সম্পন্ন বাঙালীরা তথাকথিত ‘প্রাকৃত ভেষজ’ (যা বঙ্গ সংস্কৃতির ঐতিহ্য বলে দাবি করা হচ্ছে) এদের থেকে চুরি করা হয়ে থাকতে পারে, একথা লোক সংস্কৃতিগবেষক মানিক সরকার বলতেন। আবার সুকুমার মিত্র (১৯৪০ দশকে সিপি আই-এর দৈনিক এর বার্তা সম্পাদক, যাঁর বার্তা সম্পাদনা তারিফ করতেন) একই ধারণা পোষণ করতেন। এক ধরণের আকস্মিক ও বিভেদকানী বাঙালিয়ানা প্রদীপবাবুর লেখাটা এবং মানিক সরকার ও সুকুমার মিত্রের কথা মনে করিয়ে দিল।
আপাতচোখে প্রসঙ্গান্তর মনে হলেও বাংলাদেশে আদিবাসীদের বেশ কিছু প্রজাতি কিভাবে নিশ্চিহ্ন হচ্ছে, সেদিকে দৃষ্টিক্ষেপনের আর্জি জানাচ্ছি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থশাস্ত্রের অধ্যাপক ডঃ আবুল বরকত এনিয়ে একটি প্রামান্য পুস্তক রচনা করেছেন – পোলিটিক্যাল ইকনমি অফ আনপিপলিং ইন্ডিজিনাস পিপলস। আদিবাসী নিশ্চিহ্নকরণ এক ভয়াবহ রূপ ধারণ করেছে। অথচ ওঁরাই তো এই উপমহাদেশের মূলবাসী। বাকিরা বহিরাগত (সেটলার্স)।
আরেকটি লেখায় (২০০৫ সালে ‘দৈনিক জনকন্ঠ’য় প্রকাশিত) আদিবাসীদের নির্বিত্তায়ন (যা অনিবার্যভাবে প্রকৃতিনিধন ঘটাচ্ছে) এর চিত্র তুলে ধরেছে। তা থেকে এক দীর্ঘ উদ্ধৃতি দিচ্ছি। “শেরপুরের নালিতাবাড়ী, ঝিনাইগাতী ও শ্রীবরদী উপজেলার গারো পাহাড়জুড়ে গারো, হাজং, কোচ, বানাই, বর্মণ অদিবাসীদের বসবাস। মেঘালয় ঘেঁষা গারো পাহাড়ের আদিবাসীদের বেঁচে থাকার সংগ্রাম দীর্ঘ বেদনার ঘন অধ্যায়। পরিবেশ বিপর্যয়কারী বৃক্ষের বনায়ন, বালু উত্তোলন, নদ-নদী ড্রেজিং না করা, বৃক্ষনিধনে অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক বিপর্যয়সহ পরিবেশের বিপর্যয় ঘটছে মারাত্মকভাবে। প্রাকৃতিকভাবে গড়ে ওঠা শাল, গজারি ও ওষধি গাছপালা অনেকাংশেই নিশ্চিহ্ন হয়ে পড়েছে। দেখা দিয়েছে বিরূপ প্রভাব। বর্ষা না যেতেই শুকিয়ে যায় জলাধার ও ঝরনাগুলো। দেখা দেয় অকাল বন্যা। আবাদি জমিসহ ঘরবাড়ি ডুবে যায় বন্যার পানিতে। ক্ষতিগ্রস্ত হয় অর্ধ লাখ মানুষ। পরিবেশ বিপর্যয়কারী বৃক্ষের বাগান গড়ে উঠায় হারিয়ে গেছে প্রাণী বৈচিত্র্যের পাহাড়ী সম্পদ। ভেষজ গাছ এখন খুঁজে পাওয়া যায় না।... বালিজুরি এলাকার ব্রতিন মারাক জানান, পরিবেশ বিপর্যয়ের কারণে এখন বনে তেমন পশুপাখি নেই। আদিবাসীরাও অস্তিত্ব সঙ্কটের মুখে। আদিবাসী নারী প্রমেলা মারাক জানান, পরিবেশের ভারসাম্যহীনতায় এখন পাহাড়েও ওষধি গাছ খুঁজে পাওয়া যায় না। সামান্য অসুখ হলেই যেতে হচ্ছে হাসপাতালে।”
কাজেই আদিবাসীদের সাহায্যে (মৌখিক ও পরম্পরাবাহী জ্ঞান মারফৎ) ওষধি সংরক্ষণ ও তা থেকে ঔষধি আহরণ ও প্রয়োগচিন্তা বাস্তবানুগ নয়। কেন নয়, তা বুঝেছিলাম। আমি তখন রাজ্য কৃষি দপ্তরের অধীনে কাজ করি। মাঝে মাঝেই গাঁ-গঞ্জে সমীক্ষার কাজে যেতে হ’ত। পশ্চিন দিনাজপুরে একবার এক কর্মীর প্রবল জ্বর এলো। তিন ডিগ্রির উপর জ্বর। কোন অ্যান্টিবায়োটিকেই রেমিশ্যন হচ্ছে না। এক আদিবাসী স্থানীয় কৃষি কর্মী এগিয়ে এলেন। গ্রাম থেকে এক বৃদ্ধকে ডেকে আনলেন। তিনি মাটিচাপা দিয়ে বাঁ হাতে একটি শিকড় বেঁধে দিলেন। এক বেলার মধ্যেই জ্বর উধাও। কিন্তু কিছুতেই শিকড়ের নাম বললেন না। বলা নাকি বারণ। ঠিক এমনি অভিজ্ঞতা ১৯৭০ দশকের শেষে সাঁওতাল পরগনায় এক প্রাক্তন নকশাল কর্মী সুভাষ চন্দ্র মুখার্জির (সিটি- সিপি আই এম-এল)। টেক নেম অন্য ছিল। তাঁর এক পা ফুলে ঢোল। অ্যামপিউট করার অবস্থা। সেখানেও একটি শিকড় বাঁধতে পা প্রথমে নীল হল, তারপরে ফোলা কমে গেল। সুভাষও বললেন কিছুতেই শিকড়ের নাম জানতে পারেন নি। জানানো নিষিদ্ধ।
কেন নিষিদ্ধ? উত্তর বঙ্গের চা বাগিচা শ্রমিক নেতা বলেছিলেন, “আপনাদের ওরা ‘দিকু’ (বিদেশী তথা শত্রু ভাবে)। ঠিকই। এখনো তাই আছে। সম্প্রতি কিছু তৃণমূলী বুদ্ধিজীবি বাংলা ভাষা নিয়ে দাবি তুলেছেন, সবাইকে বাংলা বলতে হবে। ভালো কথা। কিন্তু আদিবাসীরা কেন বাংলা বলবে? এতো প্রায় ‘আমরা বাঙালি ‘মার্কা কথা বার্তা? উগ্র বাঙালি জাতীয়তাবাদ। এদের দ্বারা আদিবাসীদের কাছে টানা সম্ভব? এরা আদিবাসীদের শোষণ করবে না, তার নিশ্চয়তা আছে?
Frontier Apr 7, 2017
Sankar Ray may be contacted at sankar.2010@hotmail.com
Your Comment if any
|