banner

পুস্তক সমালোচনা:
'বস্তার ২০১৬, এক প্রত্যক্ষদর্শীর জবানবন্দি'
অতীন্দ্রিয় চক্রবর্তী,
(চরৈবতি প্রকাশনা, মূল্য ৮০ টাকা)


বস্তার: শেষ কথা কে বলবে ?

বিশ্বজিৎ রায

দেশ ও জাতির উন্নয়নের নামে খনিজসমৃদ্ধ মধ্যভারতের বস্তার ও বৃহত্তর দন্ডকারণ্যে সরকার-কর্পোরেট পুঁজির যুগলবন্দি প্রাকৃতিক সম্পদের অবাধ লুন্ঠন চালাচ্ছে। চলছে ভূমিপুত্র আদিবাসীদের গণউচ্ছেদ এবং অভূতপূর্ব রাষ্ট্রীয় দমন অভিযান। সেই বীভৎসার কাহিনী শাসকীয় শত বাধা ও নিপীড়ন সত্ত্বেও জনসমক্ষে তুলে ধরছেন সচেতন ও বিবেকবান  নাগরিক সমাজের প্রতিনিধি সাহসী মানবাধিকার কর্মীবৃন্দ, ব্যতিক্রমী সাংবাদিক, বুদ্ধিজীবী ও সমাজকর্মীরা। স্বাভাবিক ভাবেই অধিকাংশ ক্ষেত্রে তাদের আলোচনা-সমালোচনার কেন্দ্রে থাকছে আদিবাসীদের উপরে রাষ্ট্রীয় পুলিশ- আধা সামরিকে ফৌজ, সহযোগী রাজনীতিক নেতা-মাফিয়াদের দ্বারা সংগঠিত ভাড়াটে খুনে বাহিনীর তান্ডবলীলা। কখনো বা প্রতিস্পর্ধী সিপিআই (মাওবাদী) দলের গেরিলাদের সঙ্গে তাদের সংঘাত তথা পারস্পরিক হত্যা-গণহত্যার সাম্প্রতিকতম ঘটনাবলী। অনেক সময়ই আড়ালে পড়ে যায় প্রাচীন গন্ডোয়ানার অধিবাসী গোন্ড ও অপরাপর আদিবাসী গোষ্ঠীগুলির অরণ্যকেন্দ্রিক অর্থনীতি ও  সমাজ-সংস্কৃতির ক্রমবিলুপ্তির কাহিনী, রামায়ণ-মহাভারতের কাল থেকে তাদের স্বাধিকার ও স্বাভিমান রক্ষায় প্রতিবাদ-প্রতিরোধের ইতিহাস। অনেক বয়ানে তারা থেকে যান সেই আদিম জনগোষ্ঠী যাদের নিজস্ব কোনো কণ্ঠস্বর নেই। একবিংশ শতকেও তাদের অভিভাবক, রক্ষক, প্রতিপালক এবং মুখপাত্র দরকার। যেন সেই ভূমিকা নিয়েই রাষ্ট্রপরিচালকবৃন্দ ও রাষ্ট্রবিরোধীদের মধ্যে রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ।

এর বিপরীতে আলোচ্য বইটি রণভূমি- বধ্যভূমি বস্তারের আদিবাসীদের কৌমজীবনের পরম্পরা ও প্রতিরোধী ইতিহাস সম্পর্কে দৃষ্টি আকর্ষণ করছে। সরাসরি না হলেও ছুঁয়ে গেছে বিকল্পসন্ধানী শিবিরের অভ্যন্তরীণ  বিতর্কটিকেও। আদতে কলকাতার ছেলে, ছত্তিশগড়ে বিলাসপুর হাইকোর্টের তরুণ আইনজীবী অতীন্দ্রিয় আরো দশজন সমসাময়িক পেশাজীবীর মতো অর্থ ও খ্যাতির মোক্ষলাভের পথ বেছে নেননি,  নিরাপদ দূরত্বে থেকে বস্তারের বিপন্ন আদিবাসীদের জন্য অশ্রুপাত করেননি। সন্দেহভাজন মাওবাদী এবং তাদের মদতদার হিসেবে পুলিশি-ফৌজি নির্যাতনে পঙ্গু, ভুয়ো সংঘর্ষে নিহত, সরকারি উর্দিধারী এবং ভাড়াটে বাহিনীর দ্বারা ধর্ষিত অসংখ্য আদিবাসী নারী-পুরুষ। বস্তার ও আশেপাশের জেলায় জেলাগুলিতে বিচারাধীন বন্দির ভিড় উপচে পড়ছে। অধিকাংশই হতদরিদ্র আদিবাসী। তাদের বারোমাস্যা আদালতের ভিতরে বাইরে শুনতে শুনতে তিনি সরেজমিন বস্তারকে জানার তাগিদ বোধ করেছেন। অধুনা হিন্দুত্ববাদীদের দ্বারা বিতাড়িত জগদলপুর লিগ্যাল এড গোষ্ঠীর সাহসিনী আইনজীবীরা তার অন্যতম প্রেরণা এবং সহযোগী। স্হানীয় বা বহিরাগত ব্যতিক্রমী সাংবাদিক-সমাজগবেষকদের কাছে বস্তারকে জানার পাশাপাশি বছর তিনেক ধরে সুধা ভরদ্বাজ, সোনি সোরির মতো মানবাধিকার কর্মীদের যোগাযোগে  আদিবাসীদের হাটে-মাঠে-বাটে  ঘুরে তাদের জানার চেষ্টা করেছেন। বইটি তারই ফলশ্রুতি।

শুরুতেই লেখক 'বস্তারিয়া কৌম প্রাকৃতের কথা' শোনান। যে আখ্যান 'শুধুই ফৌজি বনাম নকশাল, ফৌজি বনাম গ্রামবাসী, হিন্দু বনাম গোঁড়  (বা গোন্ড) লড়াই, চরম রক্তপ্লাবনে'র মন্তাজ  নয়। বরং তা রামায়ণ-মহাভারতের কাল থেকে ভারতের ভূমিপুত্র অস্ট্রিক- দ্রাবিড় জনগোষ্ঠীগুলির উপরে আরোপিত আর্যায়নের ধারাবাহিকতার ইতিবৃত্ত। আজকের ইন্দ্রপ্রস্থ –হস্তিনাপুরে ক্ষমতাসীন হিন্দুত্ববাদী সংঘ পরিবার এবং খনিজলোলুপ পুঁজিপতিদের কল্যাণে প্রান্তিক প্রাকৃতজনের 'অতল আধারিয়া পতন গাথা’। অনুচ্চ পাহাড় ও অরণ্যে ভরা রুক্ষ  এই ভূপ্রকৃতি জুড়ে উদ্ভিদ -জগৎ ও জৈব বৈচিত্র্যের অমেয় সম্ভার ছড়ানো। খাদ্য ও স্বাস্হ্য সুরক্ষা, বাসস্থান এবং জ্বালানির প্রয়োজনে বননির্ভর মানুষের উৎসব-আনন্দে, গানে-কবিতায়, লোককথায়-- এক কখায় জীবনের পরতে পরতে পাহাড়ি অরণ্যের সাথে নিবিড় আত্মীয়তা। আরণ্যক ঈশ্বরচেতনা, সৃষ্টিতত্ব, বিশ্ববীক্ষা এবং ধর্মীয় আচার-প্রথা পাহাড়-জংঙ্গল-নদী-ঝোরা, গাছপালাকেও মানবিক দোষগুণে বিশিষ্ট এবং জীবন্ত  করে তোলে।  লেখক স্মরণ করিয়ে দেন এই  আত্মীয়তা, একাত্মতার কাৰণেই ঊনবিংশ শতকেই বস্তারের গোন্ড আদিবাসীরা পার্শ্ববর্তী নিজামশাহীর মদতপুষ্ট কাঠ-ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে শ্লোগান তোলেন--- একটি গাছের বদলে একটি মাথা। একে আর্যভাষায় সংস্কৃতি বললে 'বহুস্তরে বিন্যস্ত লৌকিক কালচেতনার' যে খণ্ডিত, কৃত্রিম ছবি ভেসে ওঠে তা আটকাতে লেখক একে নাম দিয়েছেন 'প্রাকৃতি'। এই প্রাকৃতির সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিতে উদ্ভিদ ও জীবজগত, বনজ খাদ্য,  বনৌষধিভিত্তিক স্বাস্থ্যবিধির সঙ্গে স্থানীয় ধর্মবিশ্বাস, লোককথা, কৃষি- শিকার- ফলমূল সংগ্রহ- প্রাকৃতিক ভারসাম্য রক্ষা ঘিরে সামাজিক প্রথা, জন্ম-মৃত্যু-বিবাহ ঘিরে উৎসব, খাদ্যাভাস ইত্যাদির বর্ণনা এসেছে। দীর্ঘকাল ধরে এই ঐতিহ্য ধ্বংসের ইতিবৃত্তও উঠে এসেছে। উদাহরণস্বরূপ, সমুদ্র থেকে বহু দূরে পাহাড়-জঙ্গলের বাসিন্দা আদিবাসীরা চিরাচরিত 'রক সল্ট' -এর বদলে সাগরধোয়া সৈন্ধব লবণ ব্যবহার করছেন অনেক কাল। তুলনায় কিছু পরিবর্তন সাম্প্রতিক।

এই সূত্রেই লেখক 'গেরুয়া-ঝান্ডা হাতে শঙ্করাচার্যের চেলা এবং ভয়াল অত্যাধুনিক অস্ত্র হাতে ভারত-রাষ্ট্রের চেলা' দের সঙ্গে 'লাল-ঝান্ডা হাতে মাওয়ের চেলা'দেরও বিঁধেছেন ঘোটুল প্রথার প্রতি তাদের বিরূপতার কারণে। অরণ্যের দিনরাত্রি ঘিরে নাগরিক আদিখ্যেতার আড়ালে আরণ্যক মেয়েদের সঙ্গে ফস্টিনস্টিতে লালায়িত ড্যান্চিবাবুদের কল্পনায় ঘোটুল প্রথা আদিবাসী ছেলেমেয়ের প্রাক-বিবাহ অবাধ যৌনতার আসর।  কিন্তু লেখকের মতে এটি 'কিশোর-কিশোরীদের জীবনপাঠ ও কৌম যাপনের পাঠশালা' যা তাদের বৃহত্তর সামাজিক ও পারিবারিক দায়দায়িত্ব পালনের জন্য প্রস্তুত করে। ব্রাহ্মণ্যবাদী সংঘ পরিবার এবং 'নকশাল ও ফৌজিদের বদান্যতায়' প্রায় বন্ধ হয়ে গিয়েছে প্রথাটি যা তার মতে 'উপমহাদেশের গভীরতম সহজিয়া জীবনদর্শনের শেষ প্রতীকগুলির একটি’। এটি কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়, বরং ঔপনিবেশিক কাল থেকে   'আদিবাসীদের উপর নেমে আসা সামগ্রিক কালচারাল জেনোসাইডের' অংশ বলেই তার মন্তব্য।

 লেখক মনে করিয়ে দিয়েছেন খনিজনির্ভর শিল্পায়নের অর্থনীতির দাবিতে আদিবাসীদের  'সাংস্কৃতিক গণহত্যা' এবং শারীরিক গণহত্যা হাত ধরাধরি করে শুরু নেহেরু আমলে। প্রায়ান্ধকার বনভূমিতে  আধুনিক সভ্যতার আলো পৌঁছনোর কথা শুনিয়েছিলেন স্বাধীনোত্তর জনকল্যাণকামী রাষ্ট্রের প্রথম প্রধানমন্ত্রী। তার আমলেই শুরু --- বস্তার সহ বৃহত্তর দন্ডকারণ্যে আদিবাসীদের জমি ও  জঙ্গল থেকে উচ্ছেদ অভিযান। পুরোন সামাজিক কর্তৃত্বের ধাঁচার বদলে আধুনিক আমলা-মন্ত্রী- নেতা কেন্দ্রিক প্রশাসনিক  ক্ষমতার বিস্তার। তাদের লোককথা ও ধর্মবিশ্বাসের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে যুক্ত পাহাড় কেটে বাইলাডিলা ও অন্যত্র  লৌহ আকরিক নিষ্কাশন , ভিলাই, রৌরকেল্লায় রাষ্ট্রীয় ইস্পাত কারখানা স্থাপন।  শিল্প ও শিল্পশহরগুলির  জন্য বিদ্যুৎ উৎপাদনে নদীবাঁধ ও জল ও তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপন, রেললাইন বিস্তার ও নগরায়ন। প্রতিবাদ- প্রতিরোধের পরিণতিতে ষাটের দশকে বস্তারের রাজা প্রবীর ভঞ্জদেওর হত্যাকাণ্ড, আদিবাসী না হলেও যার স্মৃতি এখনো গোন্ড-মারিয়াদের হৃদয়ে। নিজেদের জল-জঙ্গল-জমিন বাঁচাতে গিয়ে সরকারি বাহিনীর লাঠি-গুলিতে আদিবাসীদের রক্ত ঝরেছে বারবার।

খনি- কারখানা - শিল্পশহর যত বেড়েছে তত বহিরাগত, বিশেষতঃ উত্তর ভারত থেকে অভিবাসীদের ভিড় বেড়েছে। এদের একটা বড় অংশই বর্ণহিন্দু যারা ঐতিহাসিকভাবেই আদিবাসীদের মনুষ্যেতর প্রাণী বা বনমানুষ বলে ভাবতে শিখেছে।  আটের দশকের শেষ দিক থেকে আদিবাসীদের উপর অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক দুই  আগ্রাসনই  বেড়ে যায় অবিভক্ত মধ্যপ্রদেশে ও তারপর নবগঠিত ছত্তিশগড়ে  হিন্দুত্ববাদী বিজেপি তথা সংঘ পরিবার ক্ষমতায় আসায়। অভিবাসী বর্ণহিন্দু ব্যবসায়ী, ঠিকাদার, সরকারি ও বেসরকারি চাকরিজীবীরা এই আগ্রাসনের মূল সামাজিক শক্তি। পৌরাণিক মহিষাসুরের  উত্তরপুরুষ বলে যারা নিজেদের শেকড়ের পরিচয় দেন সেই অসুরপুত্রকন্যা  বা কিংবদন্তির লিঙ্গোবাবার সন্তানদের আজ অসুরদলনি দুর্গা বা রাক্ষসহন্তা রামের পূজায় দীক্ষিত করার ব্রাহ্মণ্যবাদী অভিযানের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গি জড়িত হিন্দু-হিন্দি জাতীয়তাবাদের নিগড়ে তাদের আষ্টেপৃষ্টে বেঁধে ফেলা। আর জাতির উন্নয়নে বস্তারের সোনা- লোহা-বক্সাইট- টিন ইত্যাদির সম্ভার, নদী-জঙ্গল উৎসর্গ করাই তো মহাপুণ্যের কাজ।  এর বিরোধিতা মানে দেশদ্রোহিতা যার শাস্তি  হেফাজতে অত্যাচার-ধর্ষণ, বিনা বিচারে কারাবাস, ভুয়ো সংঘর্ষে মৃত্যু। সংবিধান, আইনের শাসন এবং অহিংসায় বিশ্বাসীরাও
'ঝোলাওয়ালারা'ও রেহাই পাবে না।

নয়ের দশকের শুরুতেই কেন্দ্রের কংগ্রেস সরকার নেহরুবাদী মিশ্র অর্থনীতির বদলে মুক্তবাজার অর্থনীতির জন্য দরজা খুলে দেওয়ার পর রত্নগর্ভ বস্তার তথা দণ্ডকারণ্যকে লুণ্ঠনের প্রশ্নে বিজেপি-কংগ্রেস ভাই-ভাই। বাইলাডিলার ধারাবাহিকতায় এসেছে রাওঘাট, চাররে-মাররে ভ্যালি ও অন্যত্র সরকারি 'সেইল' ও বেসরকারি টাটা-এসার-জিন্দাল-জয়সোয়ালদের খনি প্রকল্প। আদিবাসীদের নিজভূমি, জীবন-জীবিকা-সংস্কৃতি সুরক্ষায় সংবিধান ও আইনের বিধিনিষেঢের তোয়াক্কা না রেখে বিশ্বায়নের অর্থনীতির তল্পিবাহী নয়া খনি নীতি দেশি-বিদেশী কর্পোরেট কোম্পানির হাতে লুটপাটের লাইসেন্স তুলে দেওয়ার প্রক্রিয়া গতি পেয়েছে বিজেপির  রামন সিংহ সরকার নবগঠিত ছত্তিশগড়ে ক্ষমতায় আসার পর। নরেন্দ্র মোদী কেন্দ্রে আসার পর তা পূর্ণতা পেয়েছে । মধ্যবর্তী কালপর্বে আর একটি ঘটনা ঘটে। লাগোয়া অন্ধ্রপ্রদেশ থেকে সিপিআই (এম এল) জনযুদ্ধ গোষ্ঠীর গেরিলারা  বস্তারে আসতে শুরু করেন। তেলেগু আঞ্চলিকতাবাদী রাজনীতির রমরমার মুখে পুরোনো জঙ্গি  শ্রেণী-রাজনীতির প্রভাব হ্রাস এবং রাষ্ট্রীয় নিপীড়ন বৃদ্ধির মুখে দুর্গম জঙ্গল-পাহাড়ে ঘাঁটি স্থাপন এবং নতুন জনভিত্তি নির্মাণের প্রয়োজনে এই  অভিবাসন। পুলিশ, বনবাবু ও তেন্দুপাতার ঠিকেদারদের শোষণ- অত্যাচারের বিরুদ্ধে বন্দুকধারী 'দাদালোগ'দের তৎপরতা আদিবাসীদের আস্থা অর্জন করে। কালক্রমে নয়া খনি ও শিল্প নীতির জেরে পুলিশ- আধা সামরিক বাহিনী নামিয়ে ভূমিপুত্রদের জমি-জঙ্গল জবর দখলে শাসকীয় অভিযান বাড়ায় মাওবাদীদের সশস্ত্র প্রতিরোধ আদিবাসীদের  একটি বড় অংশের মধ্যে জনপ্রিয়তা পেয়েছে। ২০০৪ সালে জনযুদ্ধ ও এম সি সি গোষ্ঠীর মিলনে সিপিআই (মাওবাদী) দলের জম্ম বিদ্রোহীদের শক্তি, মনোবল ও প্রভাব আরো বাড়িয়েছে।  তাই দলের জম্মের কিছুকাল পর থেকেই কেন্দ্র-রাজ্য, বিজেপি- কংগ্রেস যৌথ উদ্যোগে ভাড়াটে খুনি বাহিনী গড়ে খতম অভিযান শুরু হয়। জন জাগরণ অভিযান, সালোয়া জুড়ুম, অপারেশন গ্রিন হান্ট, মিশন ২০১৬ ইত্যাদি নানা নামের অভিযানে গ্রামের পর গ্রাম জ্বালিয়ে, নারী-শিশু-বৃদ্ধ নির্বিচারে আদিবাসীদের হত্যা করেও মাওবাদীদের বা তাদের জনভিত্তি নির্মূল করা যায়নি। আলোচ্য বইটিতে এমন কিছু ঘাতক অভিযানের বর্ণনা রয়েছে।

 অতীন্দ্রিয় সরকার ও মাওবাদিদের মধ্যে আদিবাসীদের ' স্যান্ডউইচ' হওয়ার তত্ত্বে বিশ্বাসী নন। জল-জঙ্গল-জমিনের উপর ভূমিপুত্রকন্যাদের অধিকার, তাদের জীবন ও ইজ্জত রক্ষায় গেরিলাদের ভূমিকাকে তিনি গুরুত্ব দিয়েছেন। তবে প্রশ্ন তুলেছেন 'গাইতা-মাঝিদের দিয়ে তৈরী যে হাজার হাজার বছরের ট্রাডিশনাল এডমিনিস্ট্রেটিভ সিস্টেম তাকেও বন্ধ করা' নিয়ে। তার বক্তব্য: 'একদিকে হিন্দু বাহিনীর তান্ডব, আরেক দিকে 'কালচারাল রেভুল্যশান'—সব মিলিয়ে মিশিয়ে বিপন্নতা' বেড়েছে আদিবাসীদের কৌমজীবনে। তার কখায়, ‘বসন্তের বজ্রনির্ঘোষ'-এ কিছু মানুষের যাপন ও মননের আয়নায় জেগে উঠলো অধিকার বোধ, আবার কিছু মানুষের জীবন হয়ে গেল ছারখার। দলম-এর জনগণ সরকার-এর শাসন পদ্ধতি কিন্তু আদিবাসীদের শাসনপদ্ধতির মোট ছিল না কোনোদিনই।" 'নকশালবাদের ফলে বস্তারের মানুষদের সামগ্রিক উপকার হয়েছে না অপকার তার বিচার ইতিহাসের উপর ছেড়ে দিয়েছেন তিনি।

আজকের মুক্তবাজার অর্থনীতির উপাসক সংঘী শাসকবৃন্দ এবং সামাজিক দায়বদ্ধতায় ধ্বজাধারী পুঁজিপতিদের আশ্বাস:  লুটপাটের অর্থনীতি ও রাজনীতি  নিঃশর্ত বশ্যতায় মানলে আদিবাসীদের জীবনে অর্থনৈতিক উন্নয়নের সুফল চুঁইয়ে পড়বে । অন্যদিকে  বৃদ্ধিকেবলম মন্ত্রে দীক্ষিত সরকার ও  মুনাফালোলুপ ধনকুবেরদের মিথ্যাচারের মুখোশ খুলতে বদ্ধপরিকর জনযোদ্ধারা।   নিপীড়িত  প্রান্তিকদের ম্লান, মূক মুখে ভাষা দিতে, পুঁজির রাজসূয় যজ্ঞের আগুন থেকে তাদের বাঁচাতে  প্রতিরোধী হিংসার পাশাপাশি গণমুখী বিকল্প উন্নয়ন-প্রচেষ্টায় বিকল্প রাষ্ট্রের বীজ পুঁতছেন দুর্গম পাহাড়-জঙ্গলে।  আধুনিকতাবাদী, অভিভাবকত্বের সুর দু তরফেই। সন্দেহ নেই তাদের আধুনিকতার প্রকল্প দুটিতে বিস্তর ফারাক। লগ্নি-পুঁজির বিশ্বজয়, ভুবনগাঁয়ের প্রাকৃতিক এবং মানবিক সকল সম্পদকে মুষ্টিমেযের কুক্ষিগত করার লক্ষ্যকে আড়াল দিতে প্রকৃতিবিধ্বংসী উন্নয়ন আর মুক্তকচ্ছ  ভোগবাদের প্রবক্তাদের দোসর কেন্দ্র-রাজ্যের নব্য উদারবাদী সরকার।  বিপরীতে  মাটির কাছাকাছি জনকল্যাণমুখী উদ্যোগ, বিশেষ করে আদিবাসীদের অরণ্যের অধিকার কায়েম এবং অন্ন-বস্ত্র, শিক্ষা-স্বাস্থ্য ইত্যাদি মৌলিক প্রয়োজন ঘিরে মাওবাদী বিপ্লবীদের নানা তৎপরতা তাদের জনপ্রিয়তার অন্যতম ভিত্তি।

তবে শেষ বিচারে  মাওবাদীরা  বিশ্বজনীন সমাজপ্রগতি-বিকাশের যে মার্ক্সীয়-লেনিনীয় আখ্যানে বিশ্বাসী তাতে শ্রমজীবীদের শাসনপ্রতিষ্ঠায় শিল্পভিত্তিক নগরসভ্যতা এবং কেন্দ্রীভূত রাষ্ট্রনির্মাণ যুগপৎ ইপ্সিত এবং অনিবার্য। ফলে  আদিবাসীদের প্রকৃতিসংলগ্ন  কৌমজীবন, প্রজন্ম পরম্পরায় বাহিত প্ৰথা-বিশ্বাস-সংস্কৃতির ঐতিহ্য,  রাষ্ট্রবিচ্ছিন্নতা এবং রাষ্ট্রবিরোধীতার ইতিহাস সবটা তারা গ্রহণ করেন না।  ইউরোপীয় এনলাইটেনমেন্ট বা রেনেসাঁজারিত প্রগতিচেতনা, শিল্পবিপ্লবোত্তর সম্পদমালিকানা ও উৎপাদনকেন্দ্রীক  শ্রেণীসংগ্রাম তথা রাষ্ট্র ও
সমাজবিকাশের মার্ক্সীয় ধারণার আধারেই নয়া রাষ্ট্র ও সমাজ গড়ায় তারা বিশ্বাসী। পুঁজিবাদী পথে কৃষির ভিতে শিল্পের বিকাশ ঘটানোর প্রশ্নে সংসদীয় বামেদের বিরোধিতা করলেও রাষ্ট্রদ্যোগে শিল্পসভ্যতা তাঁদেরও ইপ্সিত গন্তব্য। দেশীয় বাস্তবতার কারণে সমতলীয় কৃষক চৈতন্যকে গুরুত্ব দিলেও প্রান্ত্রিক ও সংখ্যালঘু  জনজাতীয় কৌমচেতনার ততটুকুই গ্রহণীয় যতটুকু ধ্রুপদী আখ্যানের  মূল সুরের সঙ্গে খাপ খায়। সেটা  তাদের বিকল্প অর্থনীতি-সংস্কৃতির ভাবনা তথা প্রতিরোধী ঐতিহ্যের আখ্যান নির্মাণেও ফুটে ওঠে।

এই গ্রহণ-বর্জনের  ভালো-মন্দ নিয়ে তর্ক অনেক। তাসের দেশের মতো সোভিয়েত বলয়ের পতন আর চীনের হাঁসজারু সমাজতন্ত্রের প্রতিক্রিয়ায়  বিশেষতঃ ল্যাটিন আমেরিকায় সাম্প্রতিক  নানা বিদ্রোহ-বিপ্লবে এসব নিয়ে চাপানউতোর তুঙ্গে।  চিন্তা ও প্রয়োগের মন্থনে কৌম ও শ্রেণীচেতনার সংশ্লেষ ঘিরে অন্য সমাজতন্ত্রের প্রকল্পগুলিও ডানা মেলছে।  কিন্তু আধুনিক-উত্তর আধুনিক তরজার একাডেমিক বৃত্ত ছেড়ে  এদেশে সমাজবদলের লক্ষ্যে  তৃণমূল স্তরে সক্রিয় কর্মীদের মধ্যে এ বিষয়ে চর্চা তুলনায় কম। বিতর্কটা অবশ্য শুধু
বস্তারকেন্দ্রিক নয়। ঐতিহ্যবাদীদের  পাল্টা আধুনিকতাবাদীরা মনে করিয়ে দেন: কালের ধারায় বিশুদ্ধ ও বিচ্ছিন্ন আদিবাসী অর্থনীতি- সংস্কৃতি বলে কিছু নেই। সুদূর অতীতে সমসত্ত্ব কৌমসমাজ আদৌ ছিল কিনা এ প্রশ্ন উহ্য রেখেও বলা যায়  ঔপনিবেশিক ও উত্তর-ঔপনিবেশিক রাষ্ট্র-সমাজের সঙ্গে কখনও জবরদস্তি কখনই ঐচ্ছিক সহবাসে কৌমজীবনের গর্ভে জম্ম নিয়েছে শ্রেণীবিভক্ত সমাজ এবং স্বার্থসংঘাতের অর্থনীতি -সংস্কৃতি।  এ শিশুকে আর মাতৃগর্ভে ফেরত পাঠানো যাবে না।

 ইংরেজ আমলে নানা বিদ্রোহে এদের অনেকে নেতৃত্ব দিলেও গাইতা-মাঝি, মোড়ল-মাতব্বর, গাঁওবুড়ো, গোষ্ঠীপ্রধান  প্রমুখ পুরোনো সামাজিক কর্তৃত্বের অধিকারীরা এখন অধিকাংশ ক্ষেত্রে তুলনামূলকভাবে সম্পন্ন এবং নিজেদের স্বার্থ রক্ষায় সরকারি বাহিনী, শাসক দল, কর্পোরেটদের  দালাল। সামাজিক ভাবেও তাদের অনেকে শোষক  ও  নিপীড়নকারী। বর্ণহিন্দু, দিকুদের সঙ্গে হাত মিলিয়ে আম আদিবাসীর  দারিদ্র,  অশিক্ষা,  অন্ধবিশ্বাস ও কুসংস্কারের সুযোগ নেয় তারা। এদের মূর্তিমান উদাহরণ বস্তারে কেন্দ্র-রাজ্য, কংগ্রেস-বিজেপি যৌথ উদ্যোগে চলা  'সালোয়া জুড়ুম'  নামে চলা দানবীয় অভিযানের নেতা কুখ্যাত মহেন্দ্র করমা ও তার চেলা 'কোয়া কমান্ডো' সর্দাররা। আদিবাসীদের 'ক্রিমি লেয়ার' -এর অংশীদার করমা স্বজাতীয়দের 'জাদুঘরের দ্রষ্টব্য' রাখার বিরুদ্ধে সওয়াল  করেছে। মাওবাদীদের হাতে খুন হওয়ার আগে পর্যন্ত  টাটা-এসারদের হাত ধরে আদিবাসী  উন্নয়নের বুলি কপচেছে।

অন্যদিকে  মাওবাদীদের জনাতনা  সরকার কর্মাদের মতো  আদিবাসী ভূস্বামী ও মাফিয়াদের জমি দখল করে গরিবদের মধ্যে বন্টন করছে। সরকার, বনবাবু,  এবং তাদের দালাল সামাজিক কর্তৃত্বের কাঠামো  ভেঙে দিলেও  সমবায়িক চাষ এবং বনজ সম্পদে সামূহিক অধিকার কায়েমের মাধ্যমে কৌম ঐতিহ্যের কল্যাণকর দিক ফিরিয়ে আনছে। ইংরেজ শাসনের বিরুদ্ধে ভূমকাল বিদ্রোহের ইতিহাসকে সামনে এনেছে, গোন্ডি ভাষাকে মর্যাদা দিয়েছে, স্হানীয় উৎসবগুলিকে মান্যতা দিয়েছে। নারী অধিকার প্রশ্নে   হিন্দু-মুসলমান ও অপরাপর সম্প্রদায়ের তুলনায় 'প্যাগান' আদিবাসীরা অনেক উদার হলেও পিতৃতান্ত্রিক মূলধারার  দীর্ঘকালীন প্রভাবে তা ক্ষীয়মান।  সামাজিক ও অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে মেয়েদের  নেশাসক্তি ও পণপ্রথা বিরুদ্ধেও  মাওবাদী মহিলা সংগঠন সক্রিয়।

তবু প্রশ্ন থেকে যায়।  যে সব প্রশ্ন তুলেছেন কে বালাগোপাল, রামচন্দ্র গুহ, নন্দিনীসুন্দর প্রমুখ মানবাধিকার কর্মী ও বুদ্ধিজীবীরা। তার মূল সুর এটাই : সরকারি গণতন্ত্রে আনুষ্ঠানিক ভোটাধিকার ভিন্ন উন্নয়ন-প্রশ্নে  আদিবাসীদের কণ্ঠস্বর শোনার ও বোঝার কোনো দায় নেই।  নানা প্রকল্পের সামাজিক ও পরিবেশগত ছাড়পত্র পেতে লাঠি বাগিয়ে গাজর ঝুলিয়ে তাদের সম্মতি আদায়ই দস্তুর। আদিবাসীদের মধ্যে বিভাজন শাসকদের কাঙ্খিত। কিন্তু মাওবাদীদের জনগণতন্ত্রে আদিবাসীদের পছন্দের অধিকার, বিকল্প বাছাই এমন কি বিরোধিতার  অধিকার কতদূর? অহিংস-সহিংস প্রতিরোধের পথ হোক বা রাষ্ট্রের সঙ্গে দরকষাকষির পদ্ধতি, ঐতিহ্যরক্ষা হোক বা বিকল্প অর্থনীতি-সংস্কৃতির রূপরেখা নির্মাণ; দাদালোগ কতটা মাস্টারমশাই , কতটাই বা ছাত্র? শ্রেণীযুদ্ধের অংকে আদিবাসী সমাজের মধ্যে  হত্যা-পাল্টা হত্যার অলাতচক্রের বিস্তারকে কতটা ব্যাখ্যা করা যায়?  যাদের জীবন-জগৎ ঘিরে আজ বস্তার তথা মধ্য ভারত গৃহযুদ্ধের আগুনে জ্বলছে, তাদের নিজেদের  ভবিষ্যৎ নির্ধারণের সুযোগ কতখানি ? নাকি  অগ্রগামী, দূরদর্শী বিপ্লবী পার্টি এবং তার আত্মত্যাগী, সাহসী নেতারাই  ফের শেষ কথা বলবেন?

Dec 23, 2016


Your Comment if any