banner
bangla-bar

 

চে

ফারুক চৌধুরী
অনুবাদ: আনোয়ার জাহান সফল

 

চে অপরাজেয়। প্রলেতারীয় বিপ্লব এবং সেই বিপ্লবের বিপ্লবীরা শ্রেণী সংগ্রামের মধ্য দিয়ে এক ধাপ থেকে অন্য ধাপে এগিয়ে যান; তাই, এ বিপ্লব ও এ বিপ্লবের বিপ্লবীরা অপরাজেয়। তাই, স্বাধীনতার যে মশাল চে বহন করেন, তা কখনো নিভে যায় না; মুক্তির যে শিখা চে প্রজ্বলিত করেন, তা চির অম্লান; সাম্যের যে স্বপ্ন চে লালন করেন, তা অবিনশ্বর।

১৯২৮ সালের ১৪ই জুন। এ দিনেই চে গুয়েভারা, এই পৃথিবীর বুক থেকে আকাশের পানে প্রথম চোখ মেলে তাকান। আজ তাঁর জন্মদিন। তাই এ দিন মুক্তি-স্বাধীনতা-ন্যায়পরতা-সাম্যের বার্তা পুনর্ব্যক্ত করার উপযুক্ত সময়। যে স্বপ্নের জন্য চে বেঁচে থাকেন ও আত্মোৎসর্গ করেন, তাকে বাস্তবায়ন করার লক্ষ্যে নতুন উদ্যমে কাজ শুরু করার এখনই সময়। কারণ, বিশ্বজোড়া পুঁজির উদ্দাম গতি আর বিপজ্জনক শক্তির মুখে আমাদের গ্রহের জীবন ও প্রকৃতি হুমকি ও ধ্বংসের মুখে; কারণ, পুঁজি ক্রমবর্ধমানভাবে অসাম্যের পথকে প্রশস্ত করে তুলছে; কারণ, পুঁজি বেপরোয়াভাবে শোষণ চালিয়ে যাচ্ছে; কারণ, সর্বস্তরের জনগণের মাঝে বিভেদ সৃষ্টি করে, এমন সব ধরনের মতবাদ ও রাজনীতি ছড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে। শোষণের ভিতের উপর গড়ে ওঠা সমাজের আমূল পরিবর্তনের সমর্থক চে । শোষণ, অসাম্য, বিভেদ সৃষ্টি করে, এমন সকল বর্ণের মতবাদ ও রাজনীতি, বিশ্বজোড়া পুঁজি ও সাম্রাজ্যবাদের প্রতিপক্ষ হলেন চে। চে ব্যক্তিগত সম্পত্তি বিলোপের সমর্থক। এই ব্যক্তিগত সম্পত্তিই মানবজাতির যত দুর্গতি আর প্রকৃতি ধবংসের মূল কারণ; অথচ আজকের দিনে সেইসব বিভেদ সৃষ্টিকারী মতবাদ ও রাজনীতির প্রচারক ও অনুসারীরা একটি বারের জন্যেও এ মূল কারণের কথা তোলেন না – অথচ, ব্যক্তিগত সম্পত্তি হল পুঁজি আর জনগণের মাঝে মৌলিক এবং প্রয়োজনীয় এক বিভেদ রেখা।

চে ছিলেন ফিদেলের সব চেয়ে কাছের সহযোদ্ধাদের একজন । আর তাই, চে সম্পর্কে ব্যাখ্যা করার জন্য ফিদেল অন্যতম ভালো একজন শিক্ষক। ফিদেল তাঁদের পরিচয় পর্বের কথা স্মরণ করেন, “যে অবস্থার মধ্যে আমার আর চে’র সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল, তা অনন্য–ক্ষণস্থায়ী, কিন্তু উত্তেজনাকর ঘটনাপূর্ণ। বিপ্লবের সে প্রথম বছরগুলোয় আমরা অসাধ্য সাধন করতাম, সে ইতিহাস যেন অবাস্তব […]” (১৯৮৭ সালের ৮ই অক্টোবর, পিনার দেল রিওতে, চে’র হত্যাকাণ্ডের ২০তম বার্ষিকী উপলক্ষ্যে অনুষ্ঠানে বক্তৃতা)। এটা ছিল “অসাধ্য সাধন করা”, আর এ কঠিন কাজের মাঝেই চে নিয়োজিত ছিলেন। প্রলেতারীয় বিপ্লবীরাই এমন দায়িত্ব নেন।

ফিদেল, প্রলেতারীয় বিপ্লবী চে’র মাঝে যা খুঁজে পান, তা হচ্ছে:
“আমরা যদি একটি কমিউনিস্ট সমাজ নিয়ে কথা বলতে চাই, যদি আমাদের মূল লক্ষ্য – শুধু সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠা নয়, বরং উচ্চতর সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠা হয়ে থাকে, যদি মানবজাতি কমিউনিস্ট সমাজে বসবাসের সুউচ্চ ও অপূর্ব ধারণাকে অস্বীকার না করে, তাহলে এমন মানুষের প্রতিরূপই আমাদের প্রয়োজন। এসব মহান ধারণাকে অর্জন করতে হলে যদি আমাদের কোনো দৃষ্টান্ত, নমুনা কিংবা উদাহরণ অনুসরণের প্রয়োজন হয়, তাহলে চে’র মত মানুষই সব চেয়ে দরকারি, তেমনই প্রয়োজন তাঁকে অনুকরণকারী নর-নারীর, যারা তাঁর ধাঁচের, তাঁর মত চিন্তা করেন, তাঁর মত কাজ করেন। তাঁদেরকেই প্রয়োজন, যাঁদের প্রতিটি ক্ষুদ্র বিষয়ে, প্রতিটি কাজে, দায়িত্ব পালনের সুক্ষাতিসূক্ষ্ম ক্ষেত্রে কাজের ধরণ চে’র পরিচয় বহন করে; যাঁদের কাজে প্রকাশ পায় কাজের প্রতি চে’র মনোভাব, দৃষ্টান্ত স্থাপনের মাধ্যমে তাঁর শিক্ষাদান ও শিক্ষিত করার অভ্যাস, সকল বিষয়ে প্রথম হবার আকাঙ্ক্ষা, সব চেয়ে কঠিন, কষ্টসাপেক্ষ আর আত্ম-উৎসর্গ করার কাজে স্বেচ্ছাসেবক হওয়ার মনোভাব। চে’র মনোভাবসম্পন্ন এমন নর-নারীই প্রয়োজন, যিনি অন্যের জন্য তাঁর দেহ-মন উৎসর্গ করেন, যিনি প্রকৃত সংহতি প্রকাশ করেন, যিনি কখনো কোনো সহযোদ্ধাকে হতাশ করেন না; যিনি ত্রুটিমুক্ত মানুষ, একজন সাদাসিধে মানুষ, যিনি মুখে যা বলেন, কাজেও তা করে দেখান; যা তিনি চর্চা করেন, তাই প্রচার করেন; একজন চিন্তাশীল ও কাজের লোক। এ সব কিছুই চে’র প্রতীক।” (প্রাগুক্ত)

বিশৃঙ্খল চর্চায় পূর্ণ অর্থনীতি মানুষের জন্য কাজ করা কর্মীদের অনেককেই বিশৃঙ্খল মনোভাবে অনুপ্রাণিত করে, যা চে’র আচরণের সম্পূর্ণ বিপরীত। এসব বিশৃঙ্খল চর্চা নিশ্চেষ্টতা আর অবজ্ঞাকে অবলম্বন করে চলে। তাদের “প্রতিটি ক্ষুদ্র বিষয়ে, প্রতিটি কাজে, দায়িত্ব পালনের সুক্ষাতিসূক্ষ্ম ক্ষেত্রে” এ মনোভাব কাজ করে। তাদের এ নিশ্চেষ্টতা আর অবজ্ঞার দরুন “শিক্ষাদান ও শিক্ষিত করার” ক্ষেত্রে তারা কোনো দৃষ্টান্ত স্থাপন করেন না, সব চেয়ে কঠিন, সব চেয়ে কষ্টসাপেক্ষ, সব চেয়ে বেশি আত্মোৎসর্গ করতে হয় এমন কাজে সবার আগে স্বেচ্ছাসেবক হবার আকাঙ্ক্ষা তাদের মনে জাগে না। তারা যেমন অন্যের জন্য তাদের দেহ-মনকে উৎসর্গ করতে অনিচ্ছুক, তেমনই তারা কখনো প্রকৃত সংহতি প্রকাশ করেন না, তারা অন্য সহযোদ্ধাদের হতাশ করেন। তারা যেমন চিন্তাশীল ও কাজের লোক নন, তেমনি একজন সাদাসিধে মানুষের মত আচরণও তাদের মাঝে নেই। তারা জনগণের মাঝে যান না, যা প্রচার করেন, তা চর্চা করেন না। এ রকম বিশৃঙ্খল চর্চা হল, চে’র ছবি ছাপানো একটি টি-শার্ট পরে নিজেকে জাহির করে বেড়ানো, কেবল স্লোগান বেচে এবং সংগঠন গড়ে তোলার প্রয়োজনীয় কাজ থেকে দূরে থাকা, পরিকল্পনাহীন কর্মকাণ্ড পরিচালনা করা এবং বিশৃঙ্খলা বৃদ্ধি করা। এই সম্পূর্ণ চর্চা জনগণের স্বার্থ বিরোধী। এবং, চে এই বিশৃঙ্খল চর্চার সম্পূর্ণ বিরোধী।

যে সব প্রক্রিয়ার মাধ্যমে চে সম্পর্কে জানা সম্ভব, সেগুলোর একটি হচ্ছে কিউবার বিপ্লব। কারণ, চে এই বিপ্লবের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত ছিলেন। একইভাবে, এই বিপ্লব অনেক দিক থেকে চে’কে গড়ে তুলেছে। ফিদেল এই বিপ্লবকে বর্ণনা করেন এভাবে:
“মানুষের উপর বিশ্বাস রাখা বলতে কী বোঝায়, তার উদাহরণ হচ্ছে আমাদের বিপ্লব। কারণ, আমাদের বিপ্লব একেবারে গোড়া থেকে শুরু হয়েছিলো, একেবারে শূন্য থেকে। আমাদের হাতে একটিও অস্ত্র ছিল না, একটি পয়সাও ছিল না, এমনকি যারা এই দুর্গম পথ পাড়ি দিতে প্রস্তুত হচ্ছিলেন, তাঁরাও ছিলেন অখ্যাত মুখ। তবুও আমরা সম্ভাব্য সকল বাধাকে মোকাবেলা করেছি। আমরা প্রতিপক্ষের বিপুল অর্থকে মোকাবেলা করেছি, তাদের হাজার হাজার সৈন্যকে মোকাবেলা করেছি, এবং আমাদের বিপ্লব জয়যুক্ত হয়েছে; কারণ আমরা মনুষ্যত্বের উপর বিশ্বাস রেখেছিলাম।”

যে সামাজিক-অর্থনৈতিক-রাজনৈতিক বাস্তবতার নিরিখে চে গড়ে উঠেছিলেন, সেই দৃষ্টিভঙ্গির একটি অংশ ছিল এই বিপ্লব। একটি মহাদেশের জনগণের উপর সাম্রাজ্যবাদের থাবা পড়েছিল; সে মহাদেশে শোষণ আর বঞ্চনা ছিল; পশ্চাৎপদ ধারণার আধিপত্য ছিল সে মহাদেশে, আর সে মহাদেশেরই দ্বীপ-দেশ – কিউবা। ফিদেল, চে, তাঁদের সহযোদ্ধাগণ, এবং কিউবার জনগণকে এসবের বিরুদ্ধে সোচ্চার হতে হয়েছিল। তাঁদের বিপ্লবকে সংগঠিত করার জন্য একটি সংগঠন গড়ে তুলতে হয়েছিল।

শোষিত শ্রেণীর বিপ্লব সংগঠিত করার শক্তি এখানেই, ফিদেলের ভাষায়: “মানুষের উপর বিশ্বাস”, “বিপ্লব শুরু হয়েছিল একেবারে গোড়া থেকে, শূন্য থেকে”, “একটিও অস্ত্র ছিল না”, “একটি পয়সাও ছিল না”, এবং তবুও “সকল সম্ভাব্য বাধাকে” মোকাবেলা করা, এবং মনুষ্যত্বের উপর বিশ্বাস রাখা। শোষিত শ্রেণীর মানুষের জন্য এটি সম্পূর্ণ যৌক্তিক। কারণ, তাঁদের চিন্তাধারা যেমন আকাশ থেকে এসে পড়ে না, তেমনই কল্পনার কোনো ফাঁকা ভিত্তি হতে বেরিয়ে আসে না। শোষিত শ্রেণীর মানুষ কখনো আকাশ-কুসুম আলাপচারিতায় মগ্ন হয়ে পড়েন না। এর কারণ, তাঁরা শ্রেণী সংগ্রামকে উপেক্ষা করেন না। অপরপক্ষে, শোষকদের অবলম্বনই হচ্ছে ছলনা। কারণ, তাঁদের কাছে, অন্যদের ঠকানো এবং নিজেদের শোষণকে আড়াল করার একমাত্র পথই হচ্ছে ছলনা। বাস্তবতার এ আগুন প্রলেতারীয় বিপ্লবীদের জাগিয়ে তোলে। এ বাস্তবতার মাঝেই চে’র বিচরণ।

মানব সমাজের আমূল পরিবর্তনের কাজের সাথে সম্পর্কিত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়কে উপলব্ধি করতে চে সম্পর্কে ফিদেলের পর্যবেক্ষণ সাহায্য করে।

১৯৯২ সালে ফিদেল বলেছিলেন:
“চে […] সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠায় পুঁজিবাদী পন্থা ব্যবহারের ক্ষেত্রে দৃঢ়ভাবে বিরোধিতা করেছিলেন। […] চে দূরদৃষ্টিসম্পন্ন ছিলেন, ১৯৬০ এর দশকের প্রথম বছরগুলোতে, পূর্ব ইউরোপে সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে যে সব পন্থা ব্যবহার করা হয়েছিল, সেগুলোর সব অসুবিধা এবং পরিণতি সম্পর্কে চে অবগত ছিলেন। তিনি বলেছিলেন, ঐ সব পন্থা ও পুঁজিবাদী দর্শনকে অবলম্বন করার কোনো প্রয়োজন নেই। […] যখন আমরা দেখেছিলাম, সোভিয়েত ইউনিয়ন ও সমাজতান্ত্রিক শিবিরের আর সবাই অন্য পথ নেওয়া শুরু করেছে […] যখন তারা পুঁজিবাদের বিভাগ ও পদ্ধতিসমূহ আগের যে কোনো সময়ের চেয়ে বেশি ব্যবহারের দিকে এগিয়ে যাচ্ছিল, তখন আমি চে’র চিন্তাধারা ব্যাপকভাবে প্রচার করতে চেষ্টা করেছি । সমাজতন্ত্রের উন্নতির জন্য তাদের নেয়া উদ্যোগগুলো ছিল বিষতুল্য, আর, সে বিষ তারা বিপুল পরিমাণে ব্যবহার করে চলছিল। যা সমাজতন্ত্রকেই মেরে ফেলছিল। সমাজতান্ত্রিক শিবিরে যা ঘটেছিল, তার একটি কারণ এটি।” (নিকারাগুয়ার টমাস বোর্জের সাথে সাক্ষাৎকার, ফেস টু ফেস উইথ ফিদেল কাস্ত্রো থেকে)

পুঁজিবাদের সাথে চে’র বিরোধ, ফিদেল যেমনটি বলেন, দ্ব্যর্থহীন। এটা আসলে একটি মৌলিক বিষয়, যা শোষিতদের স্বার্থকেই রক্ষা করে। চে’র এই শ্রেণী অবস্থান, ক্রুশ্চভপন্থীদের আমলে একদল মানুষ ভুলে গিয়েছিল, আর আজ, সাম্রাজ্যবাদের একাংশের সাময়িকভাবে বিরোধিতা করা একদল লোক একে উপেক্ষা করে। ব্যক্তিমালিকানাধীন সম্পদের স্বার্থ রক্ষার্থে ভবিষ্যতে সাম্রাজ্যবাদীদের সাথে সাময়িক বিরোধিতাকারী এ দলের যুক্ত হবার সম্ভাবনা রয়েছে।

এসব বাস্তবতা চে’কে আজকের দিনে প্রাসঙ্গিক, অত্যাবশ্যকীয় ও জরুরি করে তোলে। কারণ, শোষিতদের স্বার্থ রক্ষার্থে তিনি আপোসহীন। চে যে শিক্ষা দান করেন, তা চর্চা করা এ বাস্তবতায় অত্যাবশ্যকীয় । এবং, যদি কেউ চে-কে সংকীর্ণ দৃষ্টিভঙ্গি থেকে দেখেন, যদি তাঁকে হঠকারী দৃষ্টিভঙ্গি থেকে উপস্থাপন করেন, তবে তিনি চে’র শিক্ষা হতে বিচ্যুত হবেন।

[চে গুয়েভারার জন্মবার্ষিকী উপলক্ষ্যে প্রবন্ধটি প্রথম প্রকাশিত হয়েছিল কাউন্টার কারেন্টসে (https://countercurrents.org/2017/06/che/) ২০১৭ সালের ১৪ই জুন তারিখে ।
বাংলায় প্রবন্ধটি প্রথম প্রকাশিত হয়েছে নব গণগ্রন্থের ওয়েবসাইটে (https://nggbooks.wordpress.com/2020/06/14/চে/) ১৪ই জুন, ২০২০ এ।]

Jun 17, 2020


Omar Raad Chowdhury omar.raad.chowdhury@gmail.com

Your Comment if any